নিউট্রিশন

আপেলের উপকারিতা অপকারিতা এবং চাষপদ্ধতি

“An Apple a day, keeps the doctor away.” ইংরেজিতে এই প্রবাদ বাক্যটি আমরা অবশ্যই শুনেছি। যার অর্থ দাড় হয় প্রতিদিন একটি করে আপেল খেলে আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আসলে এই প্রবাদের পেছনে কি রহস্য তা আমরা জানি কি.? এর পেছনের রহস্য হলো আপেল ভরপুর এন্টি অক্সিডেন্ট, মিনারেলস, ভিটামিন, ফাইবার ও ফ্রি রেডিক্যাল যুক্ত একটি সুস্বাদু ফল।

আপেলের পুষ্টিগুণ ক্ষতিকরদিক এবং চাষ পদ্ধতি

আপেলের বৈজ্ঞানিক নাম হলো “ম্যালাস ডোমেস্টিকা”। সারা বছর ধরে বাজারে আপেল পাওয়া যায়। যার কারণে এটি খুব সহজলভ্য একটি ফল এবং পুষ্টি ও গুণের তুলনায় এর দাম তেমন বেশি নয়। ডাক্তারদের মতে আমাদের দৈনন্দিন যেসব শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া উচিত তার মধ্যে আপেল অন্যতম।

 

আপেলের পুষ্টিগুণ:

আপেল
আপেলের উপকারিতা

সাধারণত একটি প্রমাণ সাইজের আপেলের ওজন ৯০-১৫০ গ্রাম বা তারও বেশি হতে পারে। চলুন দেখে নিই ১০০ গ্রাম আপেলে কি পরিমান পুষ্টিগুণ রয়েছে।

 

শক্তি –                     ৯৫ কিলো ক্যালরি

কার্বোহাইড্রেট –     ২৬.১৩ গ্রাম

স্যুগার –                   ১৮.৭৯ গ্রাম

ফাইবার –                 ৪.৩ গ্রাম

প্রোটিন –                  ০.৪৫ গ্রাম

ফ্যাট –                      ০.৩০ গ্রাম

 

তাছাড়া একটি আপেলে মিনারেল হিসেবে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি। পাশাপাশি বিভিন্ন ভিটামিনে ভরপুর আপেল৷ যেমন ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই এর ভালো একটি উৎস হলো আপেল।

আপেলের ছবি
লাল আপেল এর ছবি

 

 

আপেলের উপকারিতা:

 

আপেল এমন একটি ফল যার উপকার বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে ত্বক ও চুলেও আপেলের পুষ্টিগুণের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে আপেলের কয়েকটি বিশেষ উপকারিতার দিক উল্লেখ করা হলোঃ

 

. ক্যান্সার প্রতিরোধে: গবেষণায় দেখা গেছে ক্যান্সার কোষ প্রতিরোধে আপেল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন যদি কমপক্ষে একটি করে আপেল খাওয়া হয় তাহলে ক্যান্সারের মত রোগকে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত রোধ করা যায়। ফুসফুস ক্যান্সার, কোলেক্টোরাল ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার সহ এমনকি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও আপেল উপকারী একটি ফল। আপেলের মধ্যে থাকা এন্টি অক্সিডেন্টে নতুন ডিএনএ তৈরিতে সাহায্য করে এবং টিউমার কোষ ধ্বংস করে থাকে৷

 

. ওজন কমাতে: একটি নরমাল সাইজের আপেলে প্রায় ৩-৪ গ্রাম পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান থাকে৷ ফাইবার আমাদের হজম প্রক্রিয়ার গতি কমাতে সাহায্য করে ফলে খাবার হজম হওয়ার জন্য বেশি সময় প্রয়োজন হয়। যার কারণে আমাদের দ্রুত ক্ষুধা পায় না এবং অতিরিক্ত খাবার থেকে দূরে থাকতে পারি৷ তাছাড়া আপেল রক্তে স্যুগারের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত ক্ষুধা-ভাব দূর করে। ফলে সহজেই আমাদের ওজন রোধ করা যায় আপেল খাওয়ার মাধ্যমে।

 

৩. পেটের সমস্যা দূরীকরণে: আপেলে বিদ্যমান পলি-ফেনল ও ফাইবার কোলনের নালি পরিষ্কার রাখে এবং পাচনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা সচ্ছল রাখে। ফলে শরীরে পানির পরিমাণ ঠিক থাকে এবং পেট পরিষ্কার থাকে। এভাবে আপেল খাওয়ার মাধ্যমে বদহজম কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য এর মতো সমস্যা দূর করা যায়।

 

. এস্তেমা দূরীকরণে: এস্তেমার এলার্জি দূরীকরণে বিশেষত লাল রঙের আপেল ও খোসা অধিক উপকারী। কেননা এতে অধিক পরিমাণ এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা প্রাকৃতিক এন্টি হিস্টরনের কাজ করে। যা এলার্জি নিরাময়ে সহায়তা করে।

 

 . দাঁতের রঙ উজ্জ্বল: আপেলের রস দাঁতের সমস্যা রোধে বেশ উপকারী। আপেলে থাকা ফাইবার মুখে এসিডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ফলে মুখের আদ্রতা বজায় থাকে, মুখের শুকনো ভাব দূর হয় এবং দাঁতের রঙ উজ্জ্বল হয়৷ তাছাড়া চিবিয়ে আপেল খেলে ক্যাভিটি হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

 

. লিভার সুস্থ রাখে: লিভার ও অগ্নাশয়ের খুব কমন কিছু সমস্যা হলো পিত্তথলিতে পাথর, জন্ডিস, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি। নিয়মিত আপেল খেলে আপেলে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট লিভারের বিষক্রিয়াকরণ সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং লিভার সুস্থ থাকে।

 

. হাড় মজবুত করতে: আপেল একটি মিনারেলে ভরপুর ফল। এতে রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদির মতো জরুরি খনিজ পদার্থ। আর এই সকল খনিজ পদার্থ হাড়ের ক্ষয় সমস্যা দূরীকরণে ও হাড় মজবুত করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে।

 

. দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে: মিনারেলস এর পাশাপাশি আপেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি রয়েছে৷ যা আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে সজীব রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া আমরা জানি রাতকানা রোগ নিরাময়ের অন্যতম উপায় হলো ভিটামিন-এ যুক্ত খাবার খাওয়া। এক্ষেত্রে সবুজ আপেল বেশ কার্যকর।

 

. ব্রণ বা কালো দাগ দূরীকরণেঃ ত্বকের সমস্যা দূর করতে আপেলের ভূমিকা নজিরবিহীন। ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে আপেলে থাকা ভিটামিন-সই সাহায্য করে৷ তাছাড়া আপেলের সাথে আমলকি, মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে ব্যাবহার করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রণের দাগ কিংবা কালো ছাপ সহজে দূর করা যায়।

 

১০. চুল পড়া রোধে: আপেলে থাকা প্রোক্যান্ডিন বি -২ চুল লম্বা করতে এবং চুলের গোড়া মজবুত করতে সাহায্য করে। তাছাড়া আপেল থেকে তৈরি হয় হয় আপেল সিডার ভিনিগার যা চুলের সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয় যেমন চুল পড়ে যাওয়া ও খুশকি।

 

 

 

আপেলের কিছু ক্ষতিকর দিক:

 

১. আপেল খাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো সকালবেলা।ফলে হজমজনিত সমস্যা দূর হয়। অনেকেই জানতে চান রাতে আপেল খেলে কি হয়,  রাতে আপেল খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত কারণ আপেলে থাকা জৈব এসিড পাকস্থলীর এসিডকে সক্রিয় করে তোলে। ফলে পেটে গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই রাতে এবং সন্ধ্যার পর আপেল খেলে গ্যাস হয় এবং পেট ফাপা লাগতে পারে। 

 

২. কারো যদি ফ্রুক্টোজের এলার্জি থেকে থাকে তাহলে অতিরিক্ত আপেল খেলে বদহজম কিংবা বমিভাব এর মত সমস্যা হতে পারে।

 

৩. আপেল অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার হওয়ায় গর্ভবতী মা ও স্তনপান করানো মহিলাদের ক্ষেত্রে আপেল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 

 

আপেল চাষ

 

আপেল গাছঃ  

সবুজ আপেলের গাছ
সবুজ আপেল গাছের ছবি

বাংলাদেশে আপেল গাছ খুব একটা দেখা যায়না, আপেল মূলত শীত প্রধান দেশে জন্মে। এছাড়া ভারতের কাশ্মীরে আপেল ভাল পাওয়া যায়। দেশের সামান্য কিছু জেলায় আপেল সল্প পরিসরে বানিজ্যিক ভাবে আপেল চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পিরোজপুরে এবং সিরাজগঞ্জে আপেল গাছ এবং আপেলে গাছের চারা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে চাষের উপযোগী দুইটি আপেলের জাত হচ্ছে “আনা” এবং “ডরসেট গোল্ডেন” এছাড়া হরিমন৯৯ উল্লেখযোগ্য একটি জাত। বাংলাদেশে মূলত পিরোজপুরে আপেল গাছ পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্নি ভাল নার্সারীতে আপেল গাছ পাওয়া যায়। নার্সারীতে পাওয়া আপেল গাছ গুলোর দাম প্রায় ৮০০-১০০০ টাকা। 

আপেল গাছের কিছু জাতের চারাঃ 

আপেলের চারা বাংলাদেশে পরিচিত কিছু হরিমন৯৯, আন্না, ডরসেট গোল্ডেন, গ্রানি স্মিথ, নর্দান স্পাই, এম এম ১০৬ । 

বাংলাদেশে আপেল চাষ পদ্ধতিঃ

আপেল একটি অতি জনপ্রিয় সুস্বাদু ফল। যা বছরের সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীতকালের দিকে নতুন নতুন আপেল দেখতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপেল একটি শীতকালীন ফল এবং এর চাষ শীতকালে হয়ে থাকে। আপনি চাইলে নিজের বাড়িতে খুব সহজেই আপেল চাষ করতে বা গাছ লাগাতে পারেন।

সাধারণত আমাদের দেশে আপেল গাছে ফুল আসার সময় হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাসে এবং ফল পাকা শুরু হয় আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসের দিকে। বাংলাদেশের জন্য হরিমন ৯৯, আনা আপেল এবং গোল্ডেন ডরসেট আপেলের জাত চাষ করা সুবিধাজনক।

সঠিকভাবে মাটি তৈরি, গাছের পরিচর্যা এবং সার ও কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে সহজেই নিজের বাড়িতে কিংবা ছাদে আপেলের চাষ করা যায়। চারা লাগানোর জন্য ১৫ দিন আগে ২X২X২ অনুপাতের গর্ত করে জৈব সার মিশিয়ে রেখে দিতে হয় এবং অন্য সকল গাছের চারার মতোই রোপন করতে হয়। সাধারনত ২-৩ বছরের মধ্যে আপেল গাছ ফুল আসার উপযোগী হয়। 

ছাদে ও টবে আপেল চাষঃ 

আপেল গাছের ছবি
আপেল গাছ


অনেকেই শখের বশে বা বানিজ্যিক ভাবে বাসার ছাদে বা টবে আপেলের চারা রোপন করেন। অনেক সময়ই পরিচর্যা বা সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করায় আপেল গাছে ফল আসেনা। টবে কিংবা ছাদে আপেলের চারা লাগাতে কমপক্ষে ২০ ইঞ্চি সাইজের যে টব গুলো বাজারে পাওয়া যায় সে পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন। টবে ভাল পানি নিস্কাশন ব্যববস্থা থাকা প্রয়োজন পানি নিচে জমে থাকলে গাছের ক্ষতি হবে। গাছের গোড়ায় মাটিতে জৈব সার এবং বিভিন্ন উপদাআন মিলিয়ে দিতে হবে। যা আপনি নার্সারী গুলোতে সহজেই পেয়ে যাবেন। 

 

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আপেল খুব ভাল না জন্মালেও বাংলাদেশে আপেল খুবই জনপ্রিয় একটি ফল। আশা করা যায় আজকের এই পোস্ট থেকে আপেলের উপকারিতা পুষ্টিগুণ , আপকারিতা এবং আপেল গাছ এর চাষ পদ্ধতি সম্বন্ধে জেনেছেন ।